বুক রিভিউঃ আরণ্যক, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় একজন জনপ্রিয় ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক। জন্ম ১২ই সেপ্টেম্বর ১৮৯৪ এবং মৃত্যু ১লা নভেম্বর ১৯৫০। মূলত তিনি উপন্যাস ও ছোটগল্প লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। বিভূতিভূষণের ক্লাসিক উপন্যাসগুলোর মধ্যে প্রধানতম হলো ‘আরণ্যক’। এটি তার চতুর্থ উপন্যাস। উপন্যাসটির রচনাকাল ১৯৩৭-৩৯ খ্রিস্টাব্দ। বই হিসেবে প্রকাশের আগে প্রবাসী মাসিক পত্রিকায় উপন্যাসটি কার্তিক ১৯৩৮ থেকে ফাল্গুন ১৯৩৯ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।
চরিত্রসমূহ
সত্যচরণ, রাজুপাড়ে, ধাতুরিয়া, ধাওতাল সাহু, মটুকনাথ পাঁড়ে, যূগলপ্রসাদ, মঞ্ছি, ভেঙ্কটেশ্বর প্রসাদ, কুন্তা, রাজা দোবরু পান্না, রাজকন্যা ভানুমতি, রাসবিহারী সিং, নন্দলাল ওঝা, আসরফি, নকছেদী ভকত, গনোরি তেওয়ারি, বিষ্ণুরাম পাঁড়ে ইত্যাদি।
সত্যচরণ এই উপন্যাসটির অন্যতম প্রধান চরিত্র। যদিও তাকে কেন্দ্রীয় চরিত্র মনে করাটা অনেক বড় ভুল হবে। সে একজন বহিরাগত, যার সাথে জঙ্গল অথবা জঙ্গলের লোকদের কোন সম্পর্ক নেই। জঙ্গলের রহস্যভরা মঞ্চে প্রতিদিন মঞ্চায়িত হওয়া নাটকের সে শুধুমাত্র একজন দর্শক ও প্রতিবেদক। জীবনের নিবিড় রসঘনতার আচ্ছন্ন থেকে সে বর্ণনা করেছে প্রকৃতির সৌন্দর্যের। বইটিতে সর্বমোট ১৮ টি পরিচ্ছেদ রয়েছে।
আরণ্যক এর রচনাকাল ও প্রেক্ষাপট
ভাগলপুরে থাকাকালীন বিভূতিভূষণ ‘আরণ্যক’ লেখার পরিকল্পনা করেন। এটি মূলত তার একটি স্মৃতিচারণ মূলক উপন্যাস। সে সময় পাথুরিয়াঘাটা এস্টেটের সহকারী ম্যানেজার হিসেবে ইসমাইলপুর এবং আজমাবাদের অরণ্য-পরিবেশে থাকার ফলে নিসর্গরূপকার বিভূতিভূষণ ব্যাপক পরিভ্রমণ ও নানা বিষয় পর্যবক্ষেণ করেন। চাকরির সুবাদে তিনি যা কিছু পর্যবেক্ষণ করেছেন, উপলব্ধি করেছেন, তারই সুন্দর বর্ণনা আরণ্যক উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে। এই সময়ে তার দিনলিপিগ্রন্থ ‘স্মৃতির রেখা’ থেকে জানা যায়, “আজ যে স্থান টা নতুন, ভালো লাগেনা, মন বসেনা, যত দিন যায় তার সঙ্ঘে মধুর স্মৃতি যোগ হতে থাকে আর সেটা ততোটাই মধুর হয়ে উঠে।”
আরণ্যক উপন্যাসের সূচনাতেও সত্যচরণের ঠিক একই মনোভাব প্রতিফলিত হয়েছে- “জীবনের বেশিরভাগ সময় কলিকাতায় কাটাইয়াছি। বন্ধু- বান্ধব, লাইব্রেরি, থিয়েটার, গানের আড্ডা, সিনেমা এসব ভিন্ন জীবন কল্পনা করিতে পারিনা। এ অবস্থায় চাকরির কয়েকটি টাকার খাতিরে যেখানে আসিয়া পড়িলাম, এতো নির্জন স্থানের কল্পনাও কোনদিন করি নাই। প্রথম দিন দশেক কি পরিমাণ কষ্টে যে কাটিল! কতবার মনে হইলো চাকুরীর দরকার নাই, এখানে হাপাইয়া মরার চেয়ে আধপেটা খেয়ে কলকাতায় থাকা ভালো। অবিনাশের অনুরোধে কি ভুলই না করিয়াছি এই জনহীন জঙ্গলে আসিয়া। এ জীবন আমার জন্য নয়।” কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই সত্যচরণ কেই জঙ্গল যেন পেয়ে বসে। তার ভাষায়, “ দিন যতই যাইতে লাগিল, জঙ্গলের মোহ ততোই আমাকে ক্রমে পাইয়া বসিল। এর নির্জনতা ও অপরাহ্ণের সিঁদুর-ছড়ানো বনঝাউয়ের জঙ্গলের কি আকর্ষণ আছে বলিতে পারিনা। আজকাল ক্রমশ মনে হয় এই দিগন্তব্যাপী বিশাল বনপ্রান্তর ছাড়িয়া, ইহার রোদপোড়া মাটির তাজা সুগন্ধ, এই স্বাধীনতা, এই মুক্তি ছাড়িয়া কলিকাতার গোলমালের মধ্যে আর ফিরিতে পারিব না”!
কাহিনী সংক্ষেপ
(এক) পনেরো- ষোল বছর আগেকার কথা। উপন্যাসের নায়ক সত্যচরণ বি এ পাশ করেও দীর্ঘকাল কলকাতায় বেকার বসে আছে। অনেক চেষ্টা করেও সে একটা চাকরী ম্যানেজ করতে পারেনি। এদিকে মেসে তার দু’মাসের টাকা বাকি রয়েছে যার জন্য মেসের ম্যানেজার তাকে তাগাদার উপর তাগাদা দিয়ে অস্থির করে তুলেছে। সরস্বতী পূজার দিন ম্যানেজার তাকে একখানা চিঠি পাঠায় যেখানে লেখা আছে- পূজা উপলক্ষে মেসে ভালো খাওয়া- দাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে, এবং সত্যচরণ যেন অন্তত দশ টি টাকা দেয়। আর না দিতে পারলে খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু তার কাছে ২ টাকা কয়েক আনা পয়সা ছাড়া আর কোন টাকা নাই। ফলে সে লজ্জায় মেস থেকে বাইরে বেরিয়ে যায়। রাস্তায় সৌভাগ্যক্রমে কলেজের পুরনো বন্ধু সতিশের সাথে দেখা। তারা একসাথে তাদের পুরনো হিন্দু হোস্টেলে যায় এবং সেখানে গিয়ে যেমন আহার জোটে তেমনি আরও জোটে জলসার নিমন্ত্রণ। সেদিন হিন্দু হোস্টেলেই পুরনো বন্ধু অবিনাশের সাথে অনেকদিন পরে দেখা সত্যচরণ এর। অবিনাশ রা ময়মনসিংহ অঞ্চলের জমিদার। তাছাড়া পূরনিয়া জেলায় তাদের বিশাল একটা জঙ্গল- মহাল ও আছে। প্রায় বিশ- ত্রিশ হাজার বিঘে জমির বন্দোবস্তের চাকরী নিয়ে সত্যচরণ কলকাতার সেই নির্জন অরণ্যপ্রদেশে গিয়ে উপস্থিত হয়। শুরুর দিকে সেই নির্জন- অরণ্য ভূমিতে নিঃসঙ্ঘ দিন কাটাতে সত্যচরণের অবস্থা প্রায় শোচনীয় হয়ে উঠেছিলো। সে কলকাতার মানুষ, খাদ্য, গান সবকিছু কে অনেক বেশি মিস করা শুরু করলো।
“পূর্বে কি জানিতাম মানুষের মধ্যে থাকিতে এতো ভালোবাসি! তাহাদের প্রতি আমার যে কর্তব্য হয়তো সব সময় তাহা করিয়া উঠিতে পারিনা, কিন্তু ভালোবাসি তাহাদের নিশ্চয়ই। নতুবা এতো কষ্ট পাইব কেন তাহাদের ছাড়িয়া আসিয়া?”
(দুই) এই বিশাল অরণ্যভূমি পায়ে হেঁটে দেখাশোনা করা সম্ভব না। ফলে সত্যচরণ কে ঘোড়ায় চড়ে সবকিছু পরিদর্শন করতে হয়। তাছাড়া এতো হাজার বিঘা জমি অল্প সময়ে বন্দোবস্ত করা ও সহজ না। আরেকটা সমস্যা হল এই সমস্ত জমি ত্রিশ বছর পূর্বে গঙ্ঘার ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গিয়েছিলো যা আবার অন্যধারে চর হিসেবে দেখা দিয়েছে। কিন্তু যারা জমি গঙ্ঘায় বিলুপ্ত হওয়ার ফলে অন্যত্র গিয়ে বাস শুরু করেছিলো সেই পুরাতন প্রজাদেরকে জমিদার এই সব জমি দিবে না। মোটা সালামি, বর্ধিত হারে খাজনার লোভে নতুন প্রজাদের সঙ্গেই বন্দোবস্ত করতে চান। অথচ যে সব গৃহহীন, আশ্রয়হীন অতিদরিদ্র পুরাতন প্রজাকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে তারা বারবার অনুরোধ- উপরোধ কান্নাকাটি করেও জমি পাইতেছে না। এই বঞ্চিত প্রজাদের প্রতি সত্যচরণ মমতা বোধ করে। ধীরে ধীরে চারপাশের প্রকৃতি ও মানুষের সাথে তার পরিচয় ঘটতে থাকে। প্রকৃতির সৌন্দর্য ও বৈচিত্রে সে যেমন মুগ্ধ ও বিস্মিত হয় তেমনি এখানকার দরিদ্র সরল মানুষগুলো ও তাকে আকৃষ্ট করতে থাকে। পরবর্তীতে সে ও এই নির্জনতা, অরণ্য, পরিবেশ ইত্যাদির সাথে মিশে যায়।
“এখানে প্রকৃতির যে রূপ দেখিতেছি, তা আর কোথাও দেখি নাই। যতদূর চোখ যায়, এ সব যেন আমার, আমি এখানে একমাত্র মানুষ। আমার নির্জনতা ভঙ্ঘ করিতে কেউ আসিবে না। মুক্ত আকাশতলে নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় দূর দিগন্তের সীমারেখা পর্যন্ত মন কে ও কল্পনা কে প্রসারিত করিয়া দিই।”
(তিন) অরণ্যের রুক্ষতা ও ভয়াবহতার সঙ্গে সত্যচরণ আস্তে আস্তে পরিচিত হতে থাকে। নিরীহ দরিদ্র মানুষগুলোর বিপরীতে একদল হৃদয়হীন, লোভী মানুষের মুখোমুখিও তাকে হতে হয়। সে বোঝে প্রকৃতি মানেই কেবল জোৎস্না নয়, তা অনেক সময় রুক্ষ, জলহীন এবং উত্তপ্ত। নিরীহ সরল মানুষগুলোর বিপরীতে অত্যাচারী মহাজন নন্দলাল ওঝা ও আছে। যে ফুলকিয়া বইহারের পুরনো তহশিলদারকে সরিয়ে তার বড় ছেলেকে সেখানে বসাতে চায়। কারণ, সেখান থেকে টাকা পয়সা আদায়ের অনেক সুযোগ। সত্যচরণ রাজি না হওয়ায় নন্দলাল স্টেটের চিরশত্রু হয়ে থাকল। তবে এই পর্বে সত্যচরণের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হল গ্রীষ্মের অসহ্য উত্তাপ, মারাত্মক জলকষ্ট এবং বিধ্বংসী দাবানল। প্রকৃতির ও যে এমন রুক্ষ, বর্বর দিক আছে তাও এইভাবে ধীরে ধীরে তার কাছে স্পষ্ট হয়।
“যে জিনিস যত দুষ্প্রাপ্য মানুষের মনের কাছে তাহার মূল্য তত বেশি। এ কথা খুবই সত্য যে, এই মূল্য মানুষের মনগড়া একটি কৃত্রিম মূল্য, প্রার্থিত জিনিসের সত্যকার উৎকর্ষ বা অপকর্ষের সঙ্গে এর কোনো সম্বন্ধ নাই।কিন্তু জগতের অধিকাংশ জিনিসের উপরই একটা কৃত্রিম মূল্য আরোপ করিয়াই তো আমরা তাকে বড় বা ছোট করি।”
(চার) পুণ্যাহ উৎসব হয় আষাঢ় মাসে। জমিদারেরা যেদিন প্রজাদের কাছ থেকে নতুন বৎসরের জন্য খাজনা আদায় শুরু করতেন সেদিনই 'পুণ্যাহ' উৎসব। সত্যচরণ এই উপলক্ষে কাছের সমস্ত দরিদ্র প্রজাদেরও নিমন্ত্রণ জানায়। অতি দরিদ্র নিম্নবর্ণের মানুষেরা সামান্য চীনাদানা, শুড় এবং জলো টক দই খাওয়ার জন্য যেভাবে উঠোনে বসে প্রবল বৃষ্টিতে ভিজল তা দেখে সত্যচরণ দুঃখ পায়। এতো গরিব দেশ এবং গরিব মানুষ যে থাকতে পারে তা তার জানা ছিল না। এর মধ্যে ধাঁওতাল সাহু’র মতো মহাজনের সঙ্গে পরিচিত হওয়াটাও সত্যচরণের একটা বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। এরকম সৎ, নিরাসত্ত্ব ও দার্শনিক মহাজন বিরল। সে অনেক সময়ই বিনা সুদে টাকা ধার দেয়। ঋণশোধের জন্য কোনো তাগাদা করে না। মামলা করা তার স্বভাববিরোধী। তাই হাজার হাজার টাকার দলিল অনায়াসে তামা হয়ে যায় এবং সে নির্বিকার চিত্তে তা ছিঁড়ে ফেলে দেয়।
“বিত্তে নিস্পৃহতা ও বৃহৎ ক্ষতিকে তাচ্ছিল্য করিবার ক্ষমতা যদি দার্শনিকতা হয়, তবে ধাঁওতাল সাহু’র মতো দার্শনিক আমি তো অন্তত দেখি নাই।”
(পাঁচ) অরণ্যে চাকরী নিয়ে আসার দিন থেকে এ দেশের ধু - ধু মুক্ত প্রান্তর ও বনভূমি সত্যচরণ কে ক্রমশ দেশ ভুলিয়ে দিচ্ছে। সভ্য জগতের শত প্রকারের আরামের উপকরণ ও অভ্যাস কে ভুলিয়ে দিচ্ছে। এমনকি বন্ধু- বান্ধব পর্যন্ত ভুলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এই অরণ্যে এসে নানা ধরণের চরিত্রের সাথে সত্যচরণের পরিচয় হতে থাকে। প্রতাপশালী দেবী সিং রাজপুতের স্ত্রী কুন্তার দুর্দশার কথা পাটোয়ারি তাকে জানায়। এক সময় যে চরম ভোগ- বিলাসের মধ্য দিয়ে দিন কাটিয়েছে সে এখন রাতের অন্ধকারে ম্যানেজার বাবুর (সত্যচরণ) পাতের এঁটো ভাত নেওয়ার জন্য দাড়িয়ে থাকে। ছেলেমেয়েদের জন্য লুকিয়ে ফুল চুরি করতে গিয়ে ইজারাদার দের লোকের হাত থেকে মার খায়।
অন্যদিকে প্রকৃতি ও সত্যচরণ কে হাতছানি দিয়ে ডাকে। বুনো মহিষের ভয় কাটিয়ে সে ঘোড়ায় চড়ে বন- জঙ্গল পরিভ্রমণ করতে থাকে।
“জ্যোৎস্না ফুটিয়াছে। নক্ষত্রদল জ্যোৎস্নালোকে প্রায় অদৃশ্য। চারিধারে চাহিয়া মনে হয় এ সে পৃথিবী নয় এতোদিন যাহাকে জানিতাম। এ স্বপ্নভূমি, এই দিগন্তব্যাপী জ্যোৎস্নায় অপার্থিব জীবেরা এখন নামে গভীর রাত্রে। তারা তপস্যার বস্তু। বনের ফুল যারা ভালোবাসে না, সুন্দরকে চেনে না দিগ্বলয়রেখা যাদের কখনো হাতছানি দিয়া ডাকে নাই, তাদের কাছে এ পৃথিবী ধরা দেয় না কোন কালেই।”
(ছয়) মাঝে মাঝে জঙ্গল থেকে নানা অতিপ্রাকৃত ঘটনার খবর আসে। বৃদ্ধ ইজারাদারের যুবক পুত্রের শোচনীয় পরিণতির কোনো যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা হয় না। অনেকেই নাকি দেখেছে যে রাতের বেলা তাদের খাটিয়ার নীচে জঙ্গল থেকে একটি সাদা কুকুর এসে ঢোকে। আর ভোরবেলায় সে একটি মেয়েমানুষ হয়ে বেরিয়ে যায়। এর অনিবার্য ফল হল তাদের উন্মাদ হয়ে যাওয়া অথবা নির্মম ভাবে মৃত্যুবরণ। সত্যচরণের মনে হয়েছিল যে, শহরের আলোকজ্জল বৈঠকখানায় যে কাহিনি সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য বলে মনে হলে, এই আদিম অরণ্যের মধ্যে তা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।
তাছাড়া রাজু পাঁড়ে চরিত্রটি ও সত্যচরণকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে। এই গরিব ব্রাহ্মাণ চরিত্রটি আসলে অন্যরকম মানুষ, যার মধ্যে কিছু ভিন্ন দিক ও লুকোনো রয়েছে। দু-বিঘে জমি ইজারা নিয়েও সে কোনো চাষের ব্যবস্থা করে উঠতে পারেনি। চীনাঘাসের দানা খেয়ে মাস কাটিয়ে দিয়েছে। সাত্ত্বিক প্রকৃতির এই মানুষটির খেতে কাজ করার বদলে গাছের তলায় বসে বই পড়া আর আধ্যাত্মিক চিন্তায় বিভোর হওয়াই বেশি পছন্দের। শুয়োরমারি বস্তিতে কলেরার প্রাদুর্ভাব কালীন সময়ে জড়িবুটি নিয়ে রাজু চিকিৎসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ । বিনিময়ে সে কোনো অর্থের প্রত্যাশা করে না।
মহালিখারাপের ভীষণ জঙ্গলের মধ্যে অজ্ঞাত এক সৌন্দর্যভূমি রয়েছে সেটাও সত্যচরণের ই আবিষ্কার। জন্তুর ভয়কে উপেক্ষা করে এর মধ্যে ঘোড়া ছুটিয়ে বেড়ানোটি ক্রমশ তার নেশার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই অরণ্যের মধ্যেই যেন সভ্যতার আদিম স্তরটি লুকোনো আছে। তাই অরণ্য আদিম মানুষের বাসস্থান।
“বুঝি না কেন এক এক জাতির মধ্যে সভ্যতার কি বীজ লুকায়িত থাকে। তাহারা যত দিন যায় ততো উন্নতি করে। আবার অন্য জাতি হাজার বছর ধরিয়া ও সেই একস্থানে স্থানুবৎ নিশ্চল হইয়া থাকে কেন?”
(সাত) জঙ্গল - মহালে এখন সত্যচরণের ব্যাপক পরিচিতি। দেশের জন্য তার মন মাঝে মাঝে ব্যাকুল হয়ে ওঠে ঠিকই কিন্তু এখানকার প্রকৃতির মধ্যেও সে যেন নতুন ধরনের আকর্ষণ বোধ করে। আবার রাসবিহারী সিং - এর মতো দুর্দান্ত মহাজনের বাড়িতে নিমন্ত্রণ বজায় রাখতে গিয়ে এই ধনী অন্তঃপুরের রুচি ও সৌন্দর্যের অভাবও তার চোখে পড়ে। তবে রাসবিহারীর বাড়িতে শিল্পী ধাতুরিয়ার সাক্ষাৎলাভ সত্যচরণের আনন্দের কারণ হয়। এই নৃত্যশিল্পী বালকটিকে তার ভালো লাগে। ধাতুরিয়ার স্বপ্ন কলকাতায় গিয়ে নাচ দেখানো। অনেক কষ্ট করে সে যেসব ভালো ভালো নাচ শিখেছে সেখানেই তার প্রকৃত সমঝদারের দেখা পাওয়া যাবে। কিন্তু কঠোর বাস্তব সত্যটি সত্যচরণের জানা ছিল যে- শহরে ধাতুরিয়ার কোনো স্থান নেই।
“দেশের জন্য মন কেমন করা একটি অন্যরকম চমৎকার অনুভূতি। যারা চিরকাল এক জায়গায় কাটায়, স্বগ্রাম ও তাহার নিকটবর্তী স্থান ছাড়িয়া নড়ে না, তাহারা জানে না ইহার বৈচিত্র্য। দূরপ্রবাসে আত্মীয়- স্বজনশূন্য স্থানে দীর্ঘদিন যে বাস করিয়াছে সে জানে দেশের জন্য, নিজের গ্রামের জন্য দেশের প্রিয় আত্মীয় স্বজনের জন্য মন কি রকম হু- হু করে। অতি তুচ্ছ পুরাতন ঘটনাও তখন অপূর্ব বলিয়া মনে হয়। মনে হয় যাহা হইয়া গিয়াছে, জীবনে আর তাহা হইবার নহে। পৃথিবী উদাস হইয়া যায়, দেশের প্রত্যেক জিনিস টা অত্যন্ত প্রিয় হইয়া উঠে।”
(আট) প্রকৃতির যথার্থ রূপ টি উপলব্ধি করতে হলে তার সঙ্গে একা হয়ে যেতে হয়, প্রকৃতির আরাধনা করতে হয়। কেবল বাইরে থেকে ক্ষণকালের জন্য দেখলে এর অন্দরমহলে প্রবেশ করা যায় না। তাছাড়া প্রকৃতি তার ভক্তদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ আনুগত্য দাবি করে, আংশিক আনুগত্য নয়। সত্যচরণ যে মুহূর্তে এই সত্যটি উপলব্ধি করে, সেই মুহূর্তেই প্রকৃতি তার কাছে আর অজানা থাকে না। নির্জন বিশাল লবটুলিয়া বইহারের দিগন্তব্যাপী নিস্তব্ধ অরণ্যে ঘোড়ার উপর বসে, অথবা গভীর রাতে ঘরের বাইরে একা দাঁড়িয়ে সত্যচরণ ক্রমশ প্রকৃতির অজানা রহস্য বা রোমাঞ্চের সন্ধান পায়। আবার মাঝে-মাঝেই কঠোর বাস্তব উকি মারে। সীতাপুর গ্রামের এক বাঙালি ডাক্তার রাখালবাবুর অকালমৃত্যুতে তার পরিবারের শোচনীয় দুরবস্থা সত্যচরণকে আহত করে। তাছাড়া সরস্বতী কুন্ডি ও তার সৌন্দর্যের নীরব উপাসক যুগলপ্রসাদের সঙ্গে পরিচয়ই বোধ হয় সত্যচরণের জীবনের চরম প্রাপ্ত। প্রকৃতির এরকম সৌন্দর্যও যেমন তার এর আগে চোখে পড়েনি, তেমনই যুগলপ্রসাদের মতো মানুষও সে আগে আর দেখেনি। নিজের পরিশ্রম এবং অর্থব্যয় করে যে সরস্বতী কুন্ডির চারধারে নানা দুষ্প্রাপ্য ফুলের গাছ রুপন করে যাচ্ছে।
“প্রকৃতি তার নিজের ভক্তদের যা দেন, তা অতি অমূল্য দান। অনেক দিন ধরিয়া প্রকৃতির সেবা না করিলে কিন্তু সে দান মেলে না। আর কি ঈর্ষার স্বভাব এই প্রকৃতিরাণীর! প্রকৃতিকে যখন চাহিব তখন প্রকৃতিকে লইয়াই থাকিতে হইবে। অন্য কোনদিকে মন দিয়াছি যদি, অভিমানিনী কিছুতেই তার অবগুণ্ঠন খুলিবেন না।”
(নয়) লবটুলিয়া আসার তিন বছরের মধ্যে সত্যচরণের মানসিকতা সম্পূর্ণ পরিবর্তিত। এখন আর শহর তার ভালো লাগে না। উপর ওয়ালাদের ক্রমাগত তাগাদা ও আল নষ্ট করে প্রজা বসাতে তার মন চায় না। হঠাত মটুকনাথ পাঁড়ের মতো সাংসারিক কান্ডজ্ঞানহীন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত কাছারিতে এসে উপস্থিত হয়। যেখানে সভ্যজগতের মানুষেরই দেখা নেই, সেখানে সে স্কুল খুলবে। সম্পূর্ণ ফাঁকা ঘরে বসে সে কল্পিত ছাত্রদের ব্যাকরণ পড়ায়। আবার দুর্ধর্ষ রাজপুত সর্দার ছটু সিং ও তার দলবল কীভাবে নিরীহ গাঙ্গোতা প্রজাদের ফসল লুঠ করে নিতে চায় তাও সত্যচরণ চোখের সামনে দেখে। আপাতত হাঙ্গামা ঠেকানো যায় বটে, কিন্তু ছটু সিং রা যে ভবিষ্যতে চরম অশান্তির কারণ হয়ে উঠবে তাও তার কাছে স্পষ্ট হয়। আবার ফুলকিয়া বইহারের নির্জন অরণ্যে তাঁবু খাটিয়ে থাকার সময়ই সত্যচরণ বুনো মহিষের দেবতা টাড়বারোর কথা শোনে। এই দেবতা নাকি শিকারিদের হাত থেকে বুনো মহিষদের রক্ষা করেন।
“খুপরির পেছনের বনেই শিয়াল ডাকিতেছে। ছেলেমেয়ে লইয়া উহাদের মা যে কেমন করিয়া এই নির্জন বনে- প্রান্তরে থাকে তাহা বুঝিয়া উঠা কঠিন। হে বিজ্ঞ, রহস্যময় অরণ্য, আশ্রিতজনের প্রতি তোমার সত্যই বড় কৃপা।”
(দশ) জমি জরিপের কাজে প্রচন্ড শীতের মধ্যেও সত্যচরণকে দলবল নিয়ে জঙ্গলে তাঁবু খাটিয়ে থাকতে হয়। এসময় কর্মচারীদের সঙ্গে যেমন ঘনিষ্ঠতা হয়েছে, তেমনই জঙ্গলের দরিদ্রতম অধিবাসীদের জীবনযাত্রা দেখে সে চিন্তিত হয়। শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য নক্ছেদি ভকত রা সপরিবারে যে রুলাইয়ের ভূষির মধ্যে শুয়ে থাকে এটা জানার পর সে বোঝে যে, প্রকৃত ভারতবর্ষকে চেনা কত কঠিন। ফসল উঠে যাওয়ার পর ফুলকিয়া বইহারের চেহারা পালটে যায়। বাইরে থেকে ব্যবসায়ীরা ফসল কিনতে আসে। তাদের সঙ্গে সঙ্গে আসে নানা দোকানদার ও ফিরিওয়ালা। ঠাকুর - দেবতারও আমদানি ঘটে। রং - তামাশা দেখানো লোকেরাও এসে ভিড় জমায়। সকলেরই এটা দুপয়সা রোজগারের সময়। এখানে নগদ পয়সার কারবার বেশি নেই। ফসলের বিনিময়ে ফিরিওয়ালারা দরিদ্র প্রজাদের কে জিনিস বিক্রি করে এবং তাদের মারাত্মকভাবে ঠকায়।
(এগারো) সাঁওতাল রাজা দুবরো পান্না এবং তার পরিবারের সাথে পরিচিত হওয়াটা ছিল সত্যচরণের অরণ্য জীবনের সবচেয়ে বড় লাভ। এই রাজবংশই এই অঞ্চলের প্রকৃত মালিক। উত্তরে হিমালয় পর্বত, দক্ষিণে ছোটনাগপুরের সীমানা, পূর্বে কুশী নদী, পশ্চিমে মুঙ্গের একদা ছিল এঁদের রাজ্যের সীমানা। এরা বীর এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী। এদেরই পূর্বপুরুষেরা মোগল সৈন্যদের সঙ্গে লড়েছে, সাঁওতাল বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু সেই বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার সাথে সাথেই এদের সমৃদ্ধির অবসান ঘটে। সাঁওতাল বিদ্রোহের অন্যতম নেতা দুবরো পান্না এখন অতিবৃদ্ধ এবং খুবই গরিব। তিনি এখন সপরিবারে খোলার চালের বাড়ির বাসিন্দা। গরু- মহিষ চরানোই এখন তাঁদের জীবিকা। তারপরেও এই বনভূমির আদিম অধিবাসীরা তাঁকে এখনো রাজার সম্মান দেয়। সত্যচরণও তাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিয়েছে। তবে রাজার নাতির মেয়ে ভানুমতীই সত্যচরণকে মুগ্ধ করেছিল বেশি। তার প্রতি সত্যচরণের মনের গোপন কোণে একটা দুর্বলতাও দেখা দেয়।
(বারো) মাঝে মাঝে কাছারির ম্যানেজার হিসেবে সত্যচরণকে নানা বিচিত্র ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হয়। কখনও রাজু পাঁড়ের ফসলের ক্ষেতকে বুনো শুয়োরের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তাকে বন্দুক নিয়ে উপস্থিত হতে হয়, কখনো রাজুর তরুণ বয়সের প্রেমকাহিনিও শুনতে হয়। তবে কবি বেঙ্কটেশ্বর প্রসাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে সত্যচরণের ভালো লাগে। এই গ্রাম্য কবিটি জমি চাওয়ার জন্য তার কাছে আসেনি, এসেছিল কবিতা শোনানোর জন্য। এটিই সত্যচরণের সবচেয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা।
“এই নিস্তব্ধ নির্জন রাত্রে দেবতারা নক্ষত্ররাজির মধ্যে সৃষ্টির কল্পনায় বিভোর। যে কল্পনায় দূর ভবিষ্যতের নব নব বিশ্বের আবির্ভাব, নব নব সৌন্দর্যের জম্ন, নানা নব প্রানের বিকাশ বীজরূপে নিহিত। শুধু যে আত্মা নিরলস অবকাশ যাপন করে জ্ঞানের আকুল পিপাসায়, যার প্রাণ বিশ্বের বিরাটত্ব ও ক্ষদ্রত্বের সম্বন্ধে সচেতন আনন্দে উল্লসিত, জম্নজম্নান্তরের পথ বাহিয়া দূর যাত্রার আশায় যার ক্ষুদ্র, তুচ্ছ বর্তমানের দুঃখ, শোক বিন্দুবৎ মিলাইয়া গিয়াছে- সে ই তাদের সে রহস্যরূপ দেখিতে পায়।”
(তেরো) লবটুলিয়া ও নাঢ়া বইহারের ওপর সত্যচরণের টান বাড়তে থাকে। সার্ভের কাজের জন্য বাইরে গেলে তার মনে হয় যে, সে বিদেশে আছে। পরিচিত চরিত্রগুলোর সঙ্গে দেখা হলে তার মন ভালো হয়ে যায়। অনায়াসেই তাদের ঘরে সে আহার্য গ্রহণ করতে পারে। তবে দোবরু পান্নার রাজধানীতে পূর্ণিমার উৎসব দেখার অভিজ্ঞতা সত্যচরণের কাছে অতুলনীয় বলে মনে হয়। জ্যোৎস্নারাতে ভানুমতী ও তার সহচরীদের সমবেত নাচগান এক অপরূপ স্বর্গীয় পরিবেশের সৃষ্টি করে। এর মধ্য দিয়ে যেন প্রাচীন ভারতবর্ষের হারানো সংস্কৃতিরই একটি পরিচয় ফুটে ওঠে।
(চৌদ্দ) শহরের লোকের জঙ্গল সম্পর্কে অনভিজ্ঞতা এবং হাস্যকর ধারণার একটা উদাহরণ একদিন সত্যচরণ হাতেনাতেই পেয়ে যায়। কলকাতা এবং পূর্ণিয়া থেকে এক বাঙালি রায়বাহাদুরের পরিবার সরস্বতী কুণ্ডীর ধারে পিকনিক করতে এসেছে। এদের প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখার চোখ নেই, রূপ আস্বাদনের ক্ষমতা নেই। আবার এর মধ্যে যে বিপদের আশঙ্কা আছে সে সম্পর্কেও তারা অবহিত নয়। একটা সামান্য শটগান হাতে নিয়ে এই ভীষণ অরণ্যে এরা প্রবেশ করেছে। এদের কাজ প্রকৃতিকে সবদিক দিয়েই দুষিত করা।
ঘুরে ফিরে পুরনো চরিত্রদের সঙ্গে সত্যচরণের মাঝে মাঝেই দেখা হয। তাদের সুখ - দুঃখের খবর সে নেয়। তারাও সত্যচরণকে নিজেদের লোক ভেবে অনেক মনের কথা বলে। কেবল এখানকার প্রকৃতিই নয়, এখানকার মানুষগুলোর সাথেও সে ক্রমশ একাত্ম হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যে রাজা দোবরু পান্নার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে সত্যচরণ চকমকিটোলায় যায়। মহাজনেরা ঋণের দায়ে তাদের গরু- মহিষগুলোকে আটকে রেখে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত তার হস্তক্ষেপে সমস্যার আপাতত সমাধান হয়।
“কি অবর্ণনীয় শোভা দেখিলাম এই বনভূমির সেই নিস্তব্ধ অন্ধকার রাত্রে! কিন্তু মন খারাপ হইয়া গেল যখন বেশ বুঝিলাম নাড়া বইহারের এ বন আর বেশি দিন নাই। এতো ভালোবাসি ইহাকে অথচ আমার হাতেই ইহা বিনষ্ট হইলো। দু বৎসরের মধ্যেই সমগ্র মহালটি প্রজাবিলি হইয়া কুশ্রী টোলা ও নোংরা বস্তিতে ছাইয়া ফেলিল। প্রকৃতির নিজের হাতের সাজানো, তার শত বৎসরের সাধনার ফল এই নাড়া বইহার। ইহার অতুলনীয় বন্য সৌন্দর্য ও দূরবিসর্পী প্রান্তর লইয়া বেমালুম অন্তর্হিত হইবে। অথচ কি পাওয়া যাইবে ইহার বদলে?
হে অরণ্য, হে সুপ্রাচীন, আমায় ক্ষমা করিও।”
(পনেরো) ধাওতাল সাহু মহাজনের নির্লোভ এবং নিরাসক্ত চরিত্রের পরিচয় সত্যচরণ আর একবার পায়। সরকারের রেভিনিউ দাখিল করবার প্রয়োজনে তার ছয় হাজার টাকার প্রয়োজন হয়। ধাওতাল সাহু কোনো দস্তখত ছাড়াই সত্যচরণ কে অতগুলো টাকা দিয়ে দেয়। আর টাকা শোধ না হওয়া পর্যন্ত সে একদিনও কাছারির পথ মাড়ায়নি পাছে কেউ মনে করে যে, সে টাকার তাগাদা দিতে এসেছে।
ঘোর বর্ষার দিনে মাইলের পর মাইল ঘোড়া ছুটিয়ে সত্যচরণের মনে এক অনাস্থানিত আনন্দের অনুভূতি জাগে। এই বিপুল ও মহান সৌন্দর্যের আড়ালে কোনো এক মহান অদৃশ্য দেবতার উপস্থিতি অনুভব কর। তিন বছরের মধ্যে নাড়া বইহার আর লবটুলিয়ার সমস্ত জমি বিলি হয়ে যায়। বাকি থাকে সরস্বতী কুন্ডির তীরবর্তী বনভূমি। এ জমি সবচেয়ে বেশি উর্বর ফলে এর চাহিদাও বেশি। আর কতদিন এই অরণ্যভূমিকে বাঁচানো যাবে, এ সম্পর্কে সত্যচরণের মনেও সন্দেহ জাগে।
(ষোল) যুগলপ্রসাদের এখনো আশা যে, সত্যচরণ সরস্বতী কুন্ডি টি বাঁচিয়ে রাখতে পারবে। তাই এখনও সে মহালিখারূপের পাহাড়ে নতুন নতুন গাছপালার সন্ধান করে বেড়ায়। কিন্তু সত্যচরণের জানা আছে যে, লবটুলিয়া তো গেছে, সরস্বতী কুণ্ডীও যাবার মুখে। জমির ক্ষুধা বড় ভয়ানক। একটা জিনিস ক্রমশ সত্যচরণের চোখে পড়ে। যুগলপ্রসাদ ছাড়া এখানকার সবাই বৈষয়িক উন্নতি নিয়ে মাথা ঘামায়, জমি আর মোষের পরিমাণ বৃদ্ধি হলেই তারা খুশি। প্রকৃতি থাকল কি গেল তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই।
(সতেরো) সন্ধ্যার পর লবটুলিয়াকে দেখতে এখন নতুন লাগে। এখন সেখানে বিস্তীর্ণ প্রান্তর ব্যাপী শস্যক্ষেত্র আর মাঝে মাঝে অজস্র ছোটো ছোটো গ্রাম।এই নতুন জনপদে নানা ধর্ম ও বিশ্বাসের মানুষের ভিড়। জাতি বা বর্ণ নিয়ে এখানে কেউ মাথা ঘামায় না। এর মধ্যেই একদিন গিরিধারীলালের মতো নিরীহ এবং অসুস্থ মানুষকে সত্যচরণের নির্দেশে বন থেকে কাছারিতে নিয়ে আসা হয়। কুষ্ট হয়েছে সন্দেহে তাকে কেউ ছোঁয় না, আর তার সারা গায়ে হয়েছে এক রকমের ঘা। রাজু পাঁড়ের জড়িবুটির চিকিৎসায় সে ভালো হয়ে যায়।
“ইহাদের দারিদ্র্য, ইহাদের সারল্য, কঠোর জীবনসংগ্রামে ইহাদের যুঝিবার ক্ষমতা, এই অন্ধকার অরণ্যভূমি ও হিমবর্ষী মুক্তাকাশ বিলাসিতার কোমল পুষ্পাস্তৃত পথে ইহাদের যাইতে দেয় নাই। কিন্তু ইহাদিগকে সত্য পুরুষমানুষ করিয়া গড়িয়াছে।”
(আটারো) সত্যচরণের জঙ্গল থেকে বিদায় নেবার সময় এসে গেছে। যুগলপ্রসাদকে সঙ্গে নিয়ে শেষবারের মতো ভানুমতীর সঙ্গে সে দেখা করতে যায়। ভানুমতীদের আতিথেয়তার এবারেও তুলনা নেই।
“ভানুমতির কাছে বসিয়া হাতে তুলিয়া খাওয়ানোর তুলনা হয় না! জীবনে সেদিন সর্বপ্রথম আমি অনুভব করিলাম নারীর নিঃসঙ্কোচ ব্যবহারের মাধুর্য। সে যখন স্নেহ করে, তখন সে কি স্বর্গের দ্বার খুলিয়া দেয় পৃথিবীতে!!”
তবে সত্যচরণের মনে এখন বিষণ্ণতার সুর। এই বন- পাহাড় বা এই মানুষগুলোর সঙ্গে তার আর কোনোদিনই দেখা হবে না। যাবার সময় ভানুমতী হঠাৎ সত্যচরণের প্রতি মনের দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেলে, আর সত্যচরণেরও মনে হয় যে ভানুমতীকে বিবাহ করে এখানে থেকে গেলেই বোধ হয় ভালো হত। কিন্তু তার এও জানা যে, বাস্তবে তা সম্ভব নয়। তবে লবটুলিয়া ছাড়ার সময় একটি দুঃখ সত্যচরণের মনে থেকেই যায়। চাকরির শর্ত পালন করে সব জমি সে বিলি করেছে ঠিকই কিন্তু তার হাতেই তো এ অপূর্ব বনানীর ধ্বংস হয়েছে। এর জন্য অরণ্য - দেবতাদের কাছে সে ক্ষমা প্রার্থী । জঙ্গল ছেড়ে আসার পনেরো - ষোলো বছর বাদেও মাঝে মাঝে স্বপ্নের মতো অরণ্যজীবনের স্মৃতি তার মনকে উদাস করে দেয়।
“মানুষ কি চায়—উন্নতি, না আনন্দ? উন্নতি করিয়া কি হইবে, যদি তাহাতে আনন্দ না থাকে? যাহারা জীবনে উন্নতি করিয়াছে বটে, কিন্তু আনন্দকে হারাইয়াছে। অতিরিক্ত ভোগে মনোবৃত্তির ধার ক্ষইয়া ক্ষইয়া ভোঁতা—জীবন তাহাদের নিকট একঘেঁয়ে, একরঙা, অর্থহীন—মন শান বাঁধানো, রস সেখানে ঢুকিতে পারে না।”
প্রকৃতির সাথে তার কি প্রকট ঘনিষ্ঠতা তা দেখতে পায়, যখন চাকরি অবসানে অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের মুখোমুখি অরণ্যপ্রকৃতিকে পেছনে ফেলে কলকাতায় পুনর্যাত্রাকালে আক্ষেপ করে সত্যচরণ বলে-
হে অরণ্যানীর আদিম দেবতারা,
ক্ষমা করিও আমায়।
এ অঞ্চলের প্রধান খাদ্য
মকাইয়ের ছাতু, কলাইয়ের ছাতু, গমের ছাতু, বাথুয়া শাক, চীনা ঘাসের দানা, খেড়ীর দানা সিদ্ধ, গুড়মী ফল, হাতির কানের মতো পুরী, পাকা শশার রায়তা, কাঁচা তেতুলের ঝোল, মহিষের দুধের দই, পেঁড়া, ভেলি গুড়, রামদানার লাড্ডু, লাল পিঁপড়ের ডিম, পিষ্টক পিঠা ইত্যাদি।
ডামাবানু- এক ধরনের জিনপরী
টাড়বারো- বুনো মহিষের দলের দেবতা
ব্যক্তিগত মতামত
উপন্যাসের শেষে সত্যচরণের অন্তর্বেদনা পাঠক মনেও শূন্যতার অনুভূতি সঞ্চার করে। যারা আসলেই প্রকৃতি প্রেমিক, প্রকৃতির মায়া জড়ানো বন্ধনে যারা নিজেকে জড়িয়ে রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, প্রকৃতির নিয়মানুবর্তিতা যাদেরকে নিয়মিত শিহরিত করে বইটি অবশ্যই তাদের জন্য। আর সবমিলিয়ে নির্জন মায়াবী অরণ্যের বর্ণনা, সেখানকার হতদরিদ্র মানুষের জীবন সংগ্রাম, তাদের রোগ-শোক, আনন্দ-উচ্ছ্বাস, অভাব-আবেগ এবং বিভূতিভূষণের প্রগাঢ় জীবনদর্শনের সম্মেলনে আরণ্যক হয়ে উঠেছে মনের গহীনে বেঁচে থাকার মতো কালোত্তীর্ণ এক ছোট অথচ মহা আখ্যান!