দ্য সাইকোলজি অফ মানি বইতে মূলত টাকার সাথে মানুষের এটিচুড, ফিলিংস, ও অভ্যাসের ইম্প্যাক্ট নিয়ে আলোচনা করেছেন মর্গান হাউসেল। টাকা আয়ের চেয়ে টাকার ব্যবহার সম্পর্কে আমাদের সঠিক মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ টাকার সঙ্গেই আমাদের সকল আবেগ যেমন ভয়, লোভ, অধৈর্য, ভবিষ্যতের আশঙ্কা প্রভৃতি সংযুক্ত থাকে যা প্রত্যেকের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বড় ধরণের প্রভাব ফেলে।
“সবচেয়ে কঠিন আর্থিক দক্ষতা হলো নিজ লক্ষ্যকে স্থির রাখা, যাতে তা বারবার পরিবর্তিত না হয়।”
বেশীরভাগ মানুষ শুধুমাত্র আবেগ ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে জীবনে ফাইন্যান্সিয়াল ভুলগুলো করে থাকেন। সফল অর্থ ব্যবস্থাপনার জন্য আমাদের প্রয়োজন ধৈর্য ও সুপরিকল্পনা। কারণ ফাইন্যান্সিয়াল সফলতা আসে মূলত বুদ্ধিদীপ্ত বিনিয়োগ, ঝুঁকি সামলানো, ও খরচের ক্ষেত্রে ফ্রুগ্যাল হবার মাধ্যমে।
“ধন-সম্পদ এমন যা কেউই চোখে দেখে না। আমরা প্রায়ই আমাদের আশেপাশের জিনিস দেখে একে অন্যের সফলতাকে পরিমাপ করে, ব্যক্তির প্রকৃত মূল্যবোধ দিয়ে না।”
বইটা পড়ে জানতে পেরেছি যে, টাকার ব্যবহার ও সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে ইমোশন ও ব্যক্তির আচরণ কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। কেবল উচ্চ আয় অর্জন করলেই আর্থিক সাফল্য আসে না, বরং সেই টাকা ব্যবহারে সঠিক মানসিকতা ও আচরণের মাধ্যমেই আর্থিক স্থিতিশীলতা অর্জন সম্ভব। আমাদের প্রত্যেকের জীবনের মূল্যবোধ ও ফাইন্যান্সিয়াল সিদ্ধান্ত ইত্যাদি একে অপরের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে এবং তা সত্ত্বেও আমাদের উচিত একটা আনসারটেইন ভবিষ্যৎকে মেনে নিয়ে সব ধরণের ফাইন্যান্সিয়াল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
“ধন-সম্পদ তৈরিতে জ্ঞানের চেয়ে নিজের ইমোশনকে নিয়ন্ত্রণ করা বেশি জরুরী।”
উদাহরণস্বরূপ হাউসেল তুলে ধরেছেন ১৯২০-এর দশকের সেই বিখ্যাত বিনিয়োগকারী জেসি লিভারমোরকে, যিনি শেয়ারবাজার থেকে কোটি কোটি ডলার উপার্জন করেছিলেন। তবে অতিরিক্ত লোভের কারণে, সেই অর্থ অল্প সময়ের ব্যবধানেই হারিয়ে ফেলেন যা তার জীবনের মোড়কেই পাল্টে দেয়। অন্যদিকে উল্লেখ করেছেন গ্রেইস গ্রোনারকে। যিনি ছিলেন একজন অতীব সাধারণ আমেরিকান নারী। তিনি একটা খুব সাধারণ চাকরি করতেন আর আয় ও ছিল সীমিত। তারপরেও তিনি সেই সীমিত আয়ের মধ্যে থেকেও অত্যন্ত ফ্রুগ্যাল জীবনযাপন করতেন। গ্রোনার কেবল একটি কোম্পানিতেই বিনিয়োগ করেছিলেন আর কয়েক দশক ধরে সেই বিনিয়োগ বাড়তে দিয়েছিলেন। আর তিনি যখন মারা যান, তখন তার সম্পত্তির মূল্য ছিল প্রায় ৭০ লক্ষ ডলার।
“মানুষকে দেখানোর জন্য টাকা খরচ করা হচ্ছে নিজের ্টাকা কমানোর সবচেয়ে দ্রুততম পন্থা।”
এর মাধ্যমে হাউসেল বোঝাতে চেয়েছেন যে অর্থনৈতিক সাফল্য কেবল বুদ্ধিমত্তার উপর নির্ভর করে না, বরং ধৈর্য ও ফ্রুগ্যাল ইত্যাদির মতো আচরণের উপরও নির্ভরশীল। লোভের কারণে বড় ঝুঁকি নিলে তা ধ্বংসাত্মক হতে পারে, আর ফ্রুগ্যাল জীবনযাপন ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে ছোট বিনিয়োগও একসময় বড় আকারে পরিবর্তিত হয়।
দ্য সাইকোলজি অফ মানি বই থেকে আমার ১০টি লেসন্স
০১। ধৈর্য ও দীর্ঘমেয়াদী চিন্তাঃ অর্থ সঞ্চয় ও বিনিয়োগের জন্য ধৈর্য অপরিহার্য। দ্রুত বড় ধরণের সাফল্যের চেষ্টা না করে ধীরে ধীরে সঞ্চয় ও বিনিয়োগে মনোযোগ দেওয়াই দীর্ঘমেয়াদী সফলতা আনে।
০২। অর্থের সঙ্গে আচরণ গুরুত্বপূর্ণঃ টাকা আয়ের পরিমাণের চেয়ে টাকার সঙ্গে আপনার আচরণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই আচরণ টাকা খরচ, সঞ্চয় ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আপনার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে।
০৩। ঝুঁকি ও নিরাপত্তা ব্যালেন্সঃ ইনভেস্টমেন্টের ক্ষেত্রে ঝুঁকি নেয়া যেমনি খুব প্রয়োজন, ঠিক তেমনি সঠিকভাবে ঝুঁকি ম্যানেজ করতে পারাটাও জরুরী। তাই রিস্ক ও নিরাপত্তার মাঝে ভারসাম্য বজায় রেখে কাজ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
০৪। ফ্রুগ্যালিটির মূল্যঃ টাকার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে শেখা অর্থ সঞ্চয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অহেতুক খরচ এড়িয়ে ফ্রুগ্যাল হওয়ার মাধ্যমে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
০৫। পরিকল্পনার সীমাবদ্ধতাঃ ভবিষ্যৎ সর্বদা অনিশ্চিত, তাই অতিরিক্ত নিজের প্ল্যানের উপর নির্ভর না করে সেই প্ল্যানেও যে পরিবর্তন আসতে পারে তার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন।
০৬। আত্ম-নিয়ন্ত্রণঃ অর্থ সঞ্চয় ও বিনিয়োগে নিয়মিত ও নিরবিচ্ছিন্ন থাকার জন্য আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি। আবেগের বশে তাৎক্ষণিক খরচা-পাতির যে একটা লোভ তা সংবরণ করতে পারাটা একটা দীর্ঘমেয়াদী সম্পদ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
০৭। অন্যের সঙ্গে তুলনা না করাঃ ফাইন্যান্সিয়াল সিদ্ধান্তে অন্যের সঙ্গে নিজেকে তুলনা না করে নিজের অবস্থান ও লক্ষ্য অনুযায়ী সবার সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। কারণ এই ডিজিটাল যুগে একে অন্যকে দেখে, ইমিটেট বা কম্পারিজন করার একটা মনোভাব তৈরি হচ্ছে আমাদের মাঝে যেটার কারণে মানুষ প্রায়ই অপ্রয়োজনীয় চাপে পড়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।
০৮। মনের শান্তি ও সুখঃ শুধু বেশি বেশি টাকা উপার্জন, সঞ্চয়, বা সম্পদই সাফল্যের মাপকাঠি না। মনের শান্তি ও সুখ জীবনে অর্থের চেয়েও বড় সম্পদ।
০৯। অজানা পরিস্থিতি মেনে নেওয়াঃ টাকা পয়সা মূলত গ্যাম্বলিং এর মতো, আজ আছে তো কাল নেই। আর টাকা বিষয়ে সবকিছু পূর্বাভাস করাও সম্ভব না। তাই ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তাকে মেনে নিয়ে বুদ্ধিদীপ্ত/রেশনাল সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।
১০। আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনের মূল্যঃ আর্থিক স্বাধীনতা মানে অনেক টাকার মালিক হওয়া না, বরং এমন একটা অবস্থায় পৌঁছানো যেখানে আপনি টাকা নিয়ে চিন্তামুক্ত হবার পাশাপাশি নিজের শর্তে জীবনযাপন করতে পারেন।
মতামত
বইটির ভাষা সহজ ও প্রাঞ্জল, যা অর্থ ব্যবস্থাপনা বিষয়কে নতুন- পুরাতন সকল পাঠকের জন্যই সহজপাঠ্য করে তুলে ধরা হয়েছে। হাউসেল তার লেখায় বিভিন্ন উদাহরণ এবং ব্যক্তিগত গল্পের মাধ্যমে এই জটিল বিষয়গুলোকে সরলভাবে উপস্থাপন করেছেন, যা পাঠকদের জন্য চিন্তার খোরাক জোগায়।
“টাকা উপার্জন করা এক বিষয়, আর সে টাকা ধরে রাখা একেবারেই আলাদা আরেকটা বিষয়।”
তবে বইটিতে কিছু অংশ পুনরাবৃত্তি বলে আমার মনে হয়েছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে এটি একটি মূল্যবান ও শিক্ষণীয় বই, যা টাকার সঙ্গে আমাদের আচরণের মানসিক দিকগুলোকে বুঝতে সাহায্য করে। যারা আর্থিক স্বাধীনতা ও ভালোভাবে ওয়েলথ ম্যানেজ করার পাশাপাশি এই টাকা আয়- ব্যয়ের স্যাইকোলজিকে গভীরভাবে রপ্ত করতে আগ্রহী তাদের জন্য বইটি এক অনন্য নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করবে বলে বিশ্বাস রাখি।


