বুক রিভিউঃ আসমান, লতিফুল ইসলাম শিবলী
লেখক পরিচিতি
লতিফুল ইসলাম শিবলী একজন প্রখ্যাত গীতিকার, সুরকার ও সংগীত শিল্পী। তিনি একাধিক নাটক লিখেছেন। বাংলাদেশে ৯০ দশকে ব্যান্ড গানের ক্ষেত্রে অন্যতম গীতিকবি হিসেবেও পরিচিত তিনি। গীতিকার পরিচয়ের বাইরে লতিফুল ইসলাম শিবলী একাধারে কবি, গায়ক, লেখক, এবং অভিনেতাও। লিখেছেন নাটক, চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও। নাট্যকার হিসেবে তার লেখা প্রথম সাড়া জাগানো নাটক 'তোমার চোখে দেখি'। এছাড়া নিজের লেখা নাটক “রাজকুমারীতে” মির্জা গালিবের চরিত্রে অনবদ্য অভিনয়ও করেন তিনি। ৯০ দশক জুড়ে লিখেছেন জনপ্রিয় প্রায় ৪০০ গান। বিখ্যাত “হাসতে দেখো, গাইতে দেখো” গানটির তিনিই গীতিকার।
আসমান
জীবন ঘনিষ্ট এ উপন্যাস টিতে লেখকের কারুকার্য দারুণ ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এখানে লেখক শুধু শুধু কল্পনার ডানায় ভর করে বা কোন আজগুবি কাহিনী কে উপন্যাসে জায়গা দেননি। তারুণ্যদীপ্ত চোখে রঙিন দিনগুলোর শেষে যখন পাওয়া না পাওয়ার ব্যর্থতা আমাদের গ্রাস করে, তখন সেখান থেকে উত্তরনের কোন রাস্তা খোঁজে পাওয়া যায়না। কিন্তু আসমানে লেখক উত্তরনের একটি রাস্তার সন্ধান দিয়েছেন।
উপন্যাস টিতে কি নেই! রোমাঞ্চ, প্রেম, বিরহ, ভ্রাতৃত্ববোধ, ব্যর্থতা, উৎসাহ, জীবনের প্রতি মমতা, ঘুরে দাড়ানো, আছে এক বাগানসম উপমার ফুল। সেখানেরই একটি উপমা – “পৃথিবী বিচ্ছেদের স্থান, মিলনের স্থান জান্নাত।”
চরিত্রসমূহ
ওমার, রুশো, আবু ইসহাক, আনোয়ার, লামিয়া, খালিদ, আসমা, এনায়েত, ওমারের মা, জনাথন, শিমুজি ইত্যাদি।
কাহিনী সংক্ষেপ
হৃদয় ভাঙন
ওমার রিজওয়ান। নব্বয়ের দশকে যখন বাংলাদেশে রক এবং ব্যান্ড সংগীতের প্রচন্ড উম্মাদনা, তখন রক গায়ক বন্ধু রুশো’র সাথে ঢাকা শহরের পথেঘাটে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়ায় ওমার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় ছাত্র সে। প্রেমিকার অপ্রত্যাশিত প্রতারণায় বেঁচে থাকার রঙ- উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। আত্মহত্যার চেষ্টা করেও পারেনি। এখন রুশোর সাথে এখানে সেখানে ঘুরে, গাজা- ফেন্সিডিল খেয়ে কষ্ট ভুলে থাকার চেষ্টা করে।
ওমার ও লামিয়া’র প্রথম পরিচয় আন্তঃস্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতায়। সেসময় একজন ক্লাস টেনে আরেক জন নাইনে পড়তো। তাদের ভালোবাসার সূত্রপাত সেই বিতর্ক প্রতিযোগিতা থেকেই। প্রথম দেখাতেই ওমার লামিয়ার প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করে। এভাবে তারা একে অপরের কাছে আসে এবং ধীরে ধীরে স্কুল-কলেজের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু করে। দু’জন ই অত্যান্ত মেধাবী, পড়ুয়া। তাদের আলোচনা ঘিরেই থাকে বই, বিতর্ক। বিতর্কের স্পিচ তৈরিতে লামিয়া ওমার কে অনেক বেশি সাহায্য করতো। ওমার লামিয়া কে সবথেকে বেশি সম্মান করতো। সেকারণেই সে লামিয়া’র “আই লাভ ইউ” সম্পৃক্ত চিঠির উত্তরে “আই রেস্পেক্ট ইউ” লিখেছিল। তাদের চিঠির প্রথম অংশ জুড়ে থাকতো বুক রিভিউ শেষে থাকতো হৃদয় নিংডানো ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেটিং সোসাইটি থেকে ওমার কে মনোনীত করা হয়েছে ইউনাইটেড এশিয়া ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেওয়ার জন্য। ওমার কে পনেরো দিন থাকতে হবে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং এ। ওমার মোটেও যেতে রাজি না সেই কম্পিটিশনে কারণ সে লামিয়া কে ছাড়া থাকতে পারবেনা। কিন্তু লামিয়া ওমারের সাকসেস দেখতে চায় বলে তাকে কোন রকম কনভিন্স করে ফেলে। কিন্তু ইন্দোনেশিয়া থেকে ফিরে কোনভাবেই লামিয়া’র সাথে ওমার এর সাক্ষাৎ মেলে না। পরবর্তীতে জানতে পারে যে লামিয়া আসলে ওমার কে আর ভালোবাসে না। প্রথমে বিশ্বাস করতে না পারলেও ধীরে ধীরে লামিয়া’র সব কিছু ওমার চোখের সামনে দেখতে পায়।
এই প্রতারণার দুঃখ ভুলে থাকতে ওমার ড্রাগস ও সংগীতের ভেতরে ডুবে থাকার চেষ্টা করে কিন্তু সেসব ও তাকে শান্তি দিতে পারছেনা। অনেক বার সুইসাইড করতে গিয়েও বিফল হয়েছে। এতো অস্থিরতা, এতো অস্থিরতা! বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেনা। একা থাকতে পারেনা। ফলে তার বন্ধু রুশোর প্রতি কেমন যেন অনুরক্ত হয়ে পড়েছে। রুশো পাশে না থাকলে তার অস্থির লাগে। ওমারের মতে রুশোর কাছে সব আছে। ড্রাগস, মিউজিক, ফিলসফি, নেশা জাগানো তত্ত্বকথা, এডভেঞ্চার ইত্যাদি। রুশো সবকিছু ওমার এর সাথে শেয়ার করে, ওমার কে ব্যাস্ত রাখে। কিন্তু ওমার তার কষ্ট টা রুশো’র সাথে কোনভাবেই শেয়ার করতে পারেনা। রুশো’র জগত ওমার কে গ্রাস করে ফেলে কিন্তু ওমার তার কষ্টের দরজাটা খুলতে পারেনা। রুশো’র সাথে বন্ধুত্ব তাকে শান্তি দিতে পারছেনা। কি করবে ওমার?
মমতাময়ী মা
ওমারের এই ভীষণ কষ্টটা কেউ টের না পেলেও তার মা ঠিকই টের পান। বুঝতে পারেন ছেলে কোন একটা কষ্টে জর্জরিত। কিন্তু কষ্টটা কি তা তিনি জানেন না আর ওমার কে সে বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেও বাঁধে। তবে নিজ থেকে বলে- “দুঃখ-কষ্টের ভার কেউ কারোটা বহন করতে পারে না। সেটা কাঁধে নিয়েই মানুষকে নির্দিষ্ট পথ আর সময় অতিক্রম করতে হয়। সাহসী আর বুদ্ধিমানেরা ধৈর্যের সাথে এই পথ আর সময়টুকু অতিক্রম করে। বোকারা চায় তার সেই ভার অন্য কারও কাঁধে কিছুটা তুলে দিতে। তোরা যেটাকে বলিস শেয়ার করা। মানুষের ভেতরের কষ্টটা অপার্থিব, আত্মিক, আধ্যাত্মিক। আত্মিক শক্তিসম্পূর্ণ কোন মানুষ যদি তোর সেই কষ্টের সময়টুকুতে তোর বন্ধু বা পথ চলার সাথি হয় তা হলে দেখবি তোর কষ্টের সময় আর পথ খুব দ্রুতই শেষ হয়ে যাবে। এর বাইরে দুর্বল অন্তরের বন্ধুরা তোর মনের আগুনে বাড়তি কিছু খড়কুটে তুলে দেওয়া ছাড়া কিছুই করতে পারে না। এছাড়া আদতে কষ্টের কোন শেয়ার নেই।”
একদিন ওমারের মা ওমার কে বলে মসজিদে গিয়ে সে যেন ইমাম আবু ইসহাক এর সাথে দেখা করে এবং বলে মা আপনার জন্য সালাম পাঠিয়েছেন আর বলেছেন ইমাম সাহেব যেন ওমার কে বন্ধু করে নেয়। ওমার ও মায়ের কথামতো তাই করেছেন এবং ইমামের সাথে সময় কাটানো শুরু করে। উপন্যাসে একজন মা কিভাবে তার সন্তানদের মনের খবর রাখে, টের পায় এবং সদুপদেশ দিয়ে সর্বোপরি তার সন্তানের হিত কামনা করে তা আসলেই প্রশংসার দাবি রাখে। ওমারের জীবনে মায়ের যে ভূমিকা তা সত্যিই মানুষের মনকে শিহরিত করার মতো। মা ঠিক বৃষ্টির আগে যেমন পিঁপড়ারা টের পায়,ঝড় বা ভুমিকম্পের আগে যেমন পাখিরা টের পায়,আর যত আড়াল বা যত দুরেই থাকুক না কেন, সন্তানের কষ্টটা মা’রা ঠিকই টের পায়।
মেন্টরশিপ- জীবন পরিবর্তনে ইসলাম
আপনি আমাকে বন্ধু করে নিন! এই বলে মনের অগোচরে থাকা সকল দুঃখ-কষ্টের কথা সে ইমাম সাহেবের সাথে শেয়ার করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে তবে কিছুটা শান্তি ও অনুভব করে। ওমার কে এখন ছোট্ট শিশুর মতো লাগছে, মাথা নিচু করে বসে আছে ইমামের সামনে। ইমাম নরম হৃদয়ের মানুষ, তিনিও নিজেকে সামলে নিয়ে বলা শুরু করলেন- “একটা শিশুর কাছ থেকে তার খেলনা কেড়ে নাও, সেই শিশুটি যেভাবে কাঁদবে কিছুক্ষণ আগে তুমিও ঠিক সেভাবে কেঁদেছ। আজ থেকে এগারো বছর আগে আমিও সেভাবে কেঁদেছিলাম যখন আমার ছেলেটা রোড এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছিলো। সে শিশু, তুমি তরুণ আর আমি বৃদ্ধ। বয়সে আমরা যেমনই হই না কেন আমাদের কাছ থেকে প্রিয় জিনিস কেড়ে নিলে একই রকম দুঃখ লাগে। এই হঠাত আসা দুঃখ- কষ্ট আমাদের শিক্ষা দেয় সুখের জীবন কতো অনিশ্চিত! কতো ভঙ্গুর!
হোঁচট খেলে ব্যাথা লাগে, আর সেই হোঁচট খেতে খেতেই মানুষ হাঁটতে শেখে, আর মানুষ কষ্ট পেতে পেতে পরিণত হয়। জীবনের শুরুতেই তুমি যে কষ্ট টা পেয়েছ এটাকে যদি তুমি শিক্ষা হিসেবে নাও তবে তোমার বাকি জীবনে কোন কষ্ট ই তোমাকে এমন অস্থির আর ভেঙ্গে ফেলতে পারবে না।
এই বিশ্বজগত একটা পাঠশালা। এখানে প্রতিটি ঘটনার ভেতরেই একজন শিক্ষক রয়েছেন। শিক্ষক মানে কোন ব্যক্তি বা অদৃশ্য কিছু না। সেই ঘটনা টা নিজেই একজন শিক্ষক। তোমার জীবনের এই ঘটনায় তুমি একটা প্রাথমিক শিক্ষা পেলে। আর আমি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তোমাকে বলছি, আমি এরকম অনেক শিক্ষা পেতে পেতে একটা উপসংহারে পৌঁছেছি আর সেটা হল- তোমার হাতে তোমার কোন প্রিয় জিনিসই নিরাপদ নয়। যে কোন সময়ে সেটা কেড়ে নেওয়া হবে, এমনকি তোমার প্রিয় জীবন টাও। তাই শিক্ষা হল- যা পেয়েছ তার জন্য এতো উল্লাসের কিছু নেই, যা হারিয়েছ তার জন্য এতো বিষাদেরও কিছু নেই।”
মূলত মানুষের মধ্যে “পারপাস অব লাইফ”- বিষয়ে জ্ঞান না থাকার ফলে পৃথিবীর বেশীরভাগ মানুষ পৃথিবীর আলো-বাতাস ভোগ করে শেষে জঙ্গলের প্রাণী হয়ে মরে যায়। অথচ তার জম্ন হয়েছিলো মানুষ হিসেবে, মৃত্যুটাও হওয়ার কথা ছিল মানুষের মতো। এই যে সে জঙ্গলের পশুর মতো বাঁচল এর কারণ তার জীবনের একমাত্র লক্ষই ছিল ভোগ। ভোগ মানে সুখ, আর এই সুখের জন্য কি না সে করেছে! সবচেয়ে বড় ভুল যেটা করেছে সেটা হল সুখের জন্য বিচ্ছেদকে ভুলে গেছে। টাকা, বাড়ি-গাড়ি, নাম- যশ এসবকে ভালবেসে হৃদয় টা ভরতি করে রেখেছিল। এসব এমন আসক্তি যা বিচ্ছেদ কে ভুলিয়ে দেয়। অথচ বিচ্ছেদই মানুষের চরম পরিণতি।
“মানুষ তার সাথে করে একটা চিড়িয়াখানা নিয়ে ঘুরে। তার প্রয়োজন অনুসারে সে একটা করে প্রাণীকে প্রদর্শন করে অথবা কাজে লাগায়। কখনো সে বাঘ, কখনো সে হায়েনা, কখনো সে গরু-ঘোড়া অথবা গাধা, কখনো সে বিষাক্ত সাপ। মানুষ যতক্ষণ জেগে থাকে ততোক্ষণ সে এই চিড়িয়াখানা টা সামলাতে ব্যস্ত থাকে। চিড়িয়াখানা সামলানোর এই ব্যবস্থাপনা যার যতো ভালো সে ততো ভালো মানুষ। খারাপ মানুষেরা আসলে তাদের চিড়িয়াখানা ব্যবস্থাপনায় খারাপ, আর বেশি খারাপ যারা তারা তাদের চিড়িয়াখানার সকল প্রাণীর দরজা খুলে রাখে। তার সে সব ক্ষুধার্ত আর হিংস্র প্রাণীরা মানুষ, সমাজ আর রাষ্ট্রের ক্ষতি করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মানুষ যতই আধুনিক হউক না কেন, এখনো তাকে আমরা বলি অসভ্য বা ইতর। মানুষের এ লড়াই ইতরপ্রানি আর অসভ্যতা থেকে মূলত সভ্য হওয়ার লড়াই। নিজের ভেতরে লড়াই। নিজের পশুবৃত্তির বিরুদ্ধে লড়াই। ইসলাম এটাকে বলে নাফসের বিরুদ্ধে লড়াই। এটা বড় লড়াই। আর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শ্ত্রুর মোকাবিলা করাটাকে বলা হয়েছে ছোট লড়াই।”
উপন্যাসে ইমাম ইসহাকের যুক্তিবাদী চরিত্রটি মুগ্ধ করার মতো। দিকভ্রান্ত এক তরুন, যে মানবীর প্রেমে এতোটাই বুঁদ ছিলো যে সেই প্রেম হারিয়ে তার জীবনের উদ্দেশ্য হারালো, তাকে তিনি জানালেন হৃদয়ে আল্লাহর প্রেমকে স্থান দিলেই কেবল জাগতিক সব অশান্তি থেকে মুক্তি ঘটে। এখনকার তরুণদের মধ্যে যে অস্থিরতা তার সমাধানের সহজ ব্যাখা দিয়েছেন লেখক ইমামের বয়ানে। সেই অস্থিরতার স্বরূপ অনেকটা দেখিয়েছেন রুশো’র মধ্যে। রুশোর সাথে ওমারের কথোপকথনগুলোতে একজন অবিশ্বাসী আর বিশ্বাসীর দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য ফুটে উঠেছে।
“মানুষের পুরো জীবন কালটাই যুদ্ধ, লোভ-লালসার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পশু থেকে মানুষে পরিণত হওয়ার যুদ্ধ। এটাকেই বলে নাফস বা প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ।”
পুরো বই জুড়ে ইমাম সাহেব আর ওমারের যে কথোপকথন লেখক ব্যক্ত করেছেন এবং একজন ইমাম ও যে মানুষের জীবন সম্পূর্ণরূপে ভালোর দিকে পরিবর্তন করতে পারে কোন উপদেশ, জোর-জবরদস্তি বা ইসলাম কে না টেনে তা লেখক অত্যন্ত সুনিপুণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। সত্যিই ইমাম সাহেবের মতো মেন্টর প্রতিটি মানুষের জীবনে থাকা টা খুবই জরুরী বিশেষ করে বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে। বিভিন্ন ধরণের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে ওমার শান্তি খুঁজে পেলো বৃদ্ধ ইমাম ইসহাকের বন্ধুত্বে। সাধারণ হুজুরদের মতো জাহান্নামের ভয় বা জান্নাতের লোভ দেখান না তিনি ওমারকে। তিনি বলেন যুক্তির কথা, দর্শন আর জীবনের লক্ষ্যের কথা, হৃদয়ের শূন্যতার কথা। তাঁর কথা শুনতে শুনতেই ওমার অনুভব করে নিজের অন্তরের পরিবর্তন। রুশোর জীবনাদর্শ পিছে ফেলে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে শান্তি খুঁজে পায়।
“আমার মনে অশান্তির আগুন জ্বলে, কি করবো?
ওজু করো। আগুন তো পানিতেই নেভে, নাকি?”
ইমাম ইসহাকের এমন সব সহজ- সাবলীল কিন্তু অর্থপূর্ণ প্রশ্নোত্তর ওমারকে প্রতিনিয়ত আকৃষ্ট করতো।
ভ্রাতৃত্ববোধ
মসজিদেই তাবলীগ দলের সাথে ওমারের সাক্ষাৎ হয়। তাদের কনসেপ্ট ও বিশ্বাস থাকে কনভিন্স না করতে পারলেও তাদের ভাতৃত্ববোধ তাকে মুগ্ধ করেছিল। ওমার সে দলের সাথে পাকিস্তানের রাইওয়াইন্ডে ইজতেমায় অংশগ্রহণ করতে রাজি হয় চোখ খুলে পৃথিবী দেখার আশায়। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মুসলিম ভাইদের তাঁবুতে ঘুরে ঘুরে তাদের ভাতৃত্ববোধ দেখে ওমার ভীষণ মুগ্ধ হয়। ওমার হঠাৎ আকৃষ্ট হয় আফগান তালিবান সৈন্য খালিদ ইবনে হিশাম এর বক্তৃতায়। খালিদের চিন্তার স্বচ্ছতা এবং লক্ষ্যের দৃঢ়তা ওমারকে স্পর্শ করলো৷ খালিদের কথায় ওমার বুঝতে পেরেছিল নাফসের জিহাদের সাথে সাথে সশস্ত্র জিহাদেরও গুরুত্ব আছে। ওমর পাকিস্তান থেকে দেশে না ফিরে প্রাগৈতিহাসিক খাইবার পাস পাড়ি দিয়ে হিন্দুকুশের পাদদেশে আফগানিস্তানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় যুদ্ধ থামানোর যুদ্ধে অংশ নিতে। ।
“সত্য বিশ্বাসের বাণী আসে হৃদয় থেকে। সত্য যখন কথা বলে তখন মুখ বা সরতন্ত্র কথা বলেনা। মূলত কথা বলে তার হৃদয়, আর সেটা অন্য হৃদয়কে স্পর্শ করে।”
সেখানে ট্রেনিং শেষে প্রথম অপারেশনে উত্তর জোটের বিরুদ্ধে তালেবানের দুঃসাহসী অভিযানে ওমার গুরুতর আহত হয়। একেবারে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় সে। কিন্তু ওমার এই বাগড়ামের যুদ্ধে দেখেছিল তালেবান ও উত্তর জোটের উভয়ই আল্লাহু আকবার বলে ঝাপিয়ে পড়ে। এবং যাদের আক্রমণ করেছে তারাও যে কালিমাই পড়ছে! এটা ওমার কে গভীরভাবে ভাবিয়েছিল। মুসলিম হয়ে, একে অপরের ভাই হয়ে ভাই হত্যা ওমারের মন সায় দেয়নি। মারাত্মকভাবে আহত হওয়া ওমরের সেবা-শুশ্রূষার প্রয়োজনে খালিদ ওমারকে তার বাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে নার্সিং নিয়ে পড়াশোনা করা খালিদের ছোট বোন আসমার নার্সিংয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ্য হতে থাকে ওমার। যুদ্ধে ফিরলো না আর ওমার, নিজ মুসলিম ভাইদের উপর অস্ত্র ধরতে মন চাইলো না তার।
কিন্তু ১/১১ এর হামলার পর আমেরিকা শুরু করলো আফগান জনপদকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার অভিযান। আবারো সব হারালো ওমার, নিরপরাধ হওয়া স্বত্বেও তার স্থান হলো কুখ্যাত গুয়ানতানামো বে কারাগারে। বিনা বিচারে ১২ টি বছর নির্মম নির্যাতন সহ্য করেছে ওমার। আলোর মুখ দেখেনি ১২ বছর হলো। নিজের দেশেও পরিচিত আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী হিসেবে। এভাবেই লেখক বর্ণনা করেছেন জীবনের উত্থান-পতন, এবং বিশ্বাস না হারানোর গল্প হিসেবে ‘আসমান”।
“চেনাজানা সব দরজা বন্ধ হয়ে গেলে, খুলে যায় একটা অচেনা দরজা। জীবন বন্দী হয়ে গেলে সেটা জীবনকেও ছাপিয়ে যায়। সেই জীবনের গল্প জীবনের চেয়েও বড় হয়ে যায়।”
হৃদয় আল্লাহর ঘর
ওমারের অসুস্থ্যতাকালীন সময়ে আসমা তার সাধ্যমতো চেষ্টা করে তাকে সারিয়ে তুলে। সেই সেবা শুশ্রূষা’র সময় একে অপরের প্রতি টান- ভালোবাসা অনুভব করে। কিন্তু ইমাম সাহেব ওমারকে বলেছিলেন “হৃদয় আল্লাহর ঘর”। ওমার সেই হৃদয়ে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে প্রবেশ করাতে চায়নি। যদিও সেই হৃদয় আরো একজন দখল নিয়েছে সে হলো আসমা। তারা দুজনেই বুঝতে পেরেছিল তাদের হৃদয়ে একে অপরের বাস। তারা নিজেদের ভাগ্যকে তুলে দিয়েছিল মহান সৃষ্টিকর্তার সিদ্ধান্তের উপর।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ার হামলার জের ধরে আমেরিকানরা হামলাকারীকে গ্রেপ্তারের জন্য উত্তর জোটের সাথে মিলে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে তালিবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই যুদ্ধকালীন সময়ে পারিবারিক ভাবে ওমার আর আসমা’র বিয়ে হয়। এবং এই যুদ্ধ ওমারের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। বিয়ের ১৪ দিনের মাথায়
তকদিরে বিশ্বাসী ওমারকে তকদির টেনে নিয়ে যায় আমেরিকার কুখ্যাত গুয়ান্তানামো বে জেলে। আসমা বলেছিল উমার পাখি হয়ে উড়ে গেলে সে আসমান হয়ে যাবে। কিন্তু বন্দী ওমার আজ আসমা’র কাছ থেকে দূরে বহুদূরে। ওমার জানে না তার আসমান কোথায় আছে, কিভাবে আছে? কিন্তু এমনই এক বিভোর সময়ে শিমুজি ওমারের জন্য সুখের সান্নিধ্য- আসমা কে নিয়ে হাজির হয় আলবেনিয়ার এয়ারপোর্টে। তাদের মধ্যে অনেক কথা বার্তা হয়। অবশেষে সবকিছুর জন্য হঠাত শিমুজির প্রতি ওমারের মমতা তাকে স্পর্শ করে গেলো। কৃতজ্ঞতায় তার চোখ ছলছল করে উঠলো। শিমুজিকে আলিঙ্গন করলো, শিমুজিও পরম মমতায় ওমার কে বুকে চেপে ধরল।
অবশেষে, এই বিশ্বজগত সৃষ্টি করা হয়েছে তোমার জন্য, আর তোমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে তার (মহান আল্লাহ) জন্য। তুমি যখন তার হবে এই বিশ্বজগতের সব কিছুই তোমার হবে।
ব্যক্তিগত মতামত
লেখকের কঠিন দর্শনের কথা সহজভাবে বোঝানোর মুন্সিয়ানা প্রসংশা করার মতো। হতাশায় পতিত জীবন থেকে ফিরে আসা, জ্ঞান পিপাসু মানুষের জীবনালাপ, সহজ যুক্তি দিয়ে ভাবতে শেখা, মানুষ- নিজের জীবন আর সর্বোপরি সবকিছুর উর্ধে স্রষ্টাকে ভালোবাসা, এবং স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসার পরিচর্যার গল্প আসমান।